রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন রােমান্টিক কবি, সত্যদ্রষ্টা তাঁর বিশ্বাস ছিল মানুষের শাশ্বত মূল্যবােধে। সমকালীন ভূমিতে দাঁড়িয়ে একদিকে যেমন ভারত ইতিহাসের অতীত কালানুক্রম লক্ষ করেছেন, অপরদিকে তেমনি ইতিহাসের অন্তর্নিহিত চিরন্তন সত্যকে প্রত্যক্ষ করেছেন। দেখেছেন দিগবিজয়ী যােদ্ধার দস্ত, অহংকার, রণশক্তি, প্রতাপ, বাহুবল, রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম কিংবা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শোষণ-পীড়ন-পেষণ জলবুদবুদের মতাে ক্ষনস্থায়ী, কারণ দিগবিজয় রণহুংকার সাম্রাজ্যবিস্তার প্রভৃতির মধ্যে মানবতার সামান্যতম অস্তিত্ব থাকে না, বরং মানবধর্ম পদে-পদে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও পদদলিত হয়। শক্তির বহিঃপ্রকাশ কিংবা ঐশ্বর্যের চোখ ধাঁধানাে স্বপ্নালােক সাময়িক দৃষ্টিবিভ্রম ঘটালেও কালের প্রবাহে তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মানুষের সার্বিক স্মৃতিতে তার স্থান হয় না, শিশুপাঠ্য ইতিহাসগ্রন্থে মুখ ঢেকে আপন অস্তিত্ব রক্ষার স্থান খোজে। সে রবীন্দ্রনাথ এরকম ইতিহাস চেতনার সূক্ষ্ম অনুভূতি থেকে প্রশ্নো্ধৃত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।

 মানবসভ্যতার ইতিহাসে 'সাশ্রাজ্যলােভী-দের ভূমিকা বড়ােই ন্যক্কারজনক, তারা পররাজ্য- আগ্রাসী, তারা রণােন্মত্ত, রণবিজয়ের অংহকারে আর শক্তিদন্তে তারা বিজিত মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করে না । শােষণে-শাসনে-অত্যাচারে-পীড়নে মনুষ্যত্বহীনতার পরিচয় রাখে পদে-পদে, ইতিহাসে তারা পররাজ্যগ্রাসী অত্যাচারী শাসকরূপেই চিহ্নিত হয়। শাসিত ও শােষিত মানুষের হৃদয়ে তাদের স্থান হয় না, তাদের সাম্রাজ্যবিজয় ও রাজ্যশাসনের স্মারকচিহ্ন মানবজাতির ইতিহাসে মহত্ত্ব ও গৌরবের পরিচায়ক বলে আখ্যাত হয় না, অমানুষী, অবিবেকী কাজ বলেই গণ্য হয়। তাদের রাজত্বকাল ইতিহাসের লজিকত অধ্যায়।

 ইতিহাসের কালপ্রবাহের ঘটনাপঞিা প্রত্যক্ষ করার অবকাশে রবীন্দ্রনাথ ধুলামাটি ভরা পৃথিবীর
শাস্বতকালের অযুত শ্রমজীবী মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অক্ষয় অভিত্বকে নিরীক্ষণ করেছেন। ইতিহাসের রাজশক্তির সাম্রাজ্যবিস্তার ও রাজ্যশাসনের সমান্তরালে ওই কর্মব্রতী মানুষের জীবনস্রোতও বয়ে চলেছে সুখ-দুঃখের উপলবিত্তীর্ণ বন্ধুর পথ অতিক্রম করে যুগ-যুগান্তর ধরে। কত সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ঘটেছে, ইতিহাসের কালানুক্রমে কত রাজা সিংহাসনে বসেছেন, সিংহাসন হারিয়েছেন, কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের কর্মমুখরতা থেকেছে অব্যাহত।

দেখি সেথা কলকলরবে
বিপুল জনতা চলে
নানা পথে নানা দলে দলে
যুগ যুগান্তর হতে মানুষের নিত্যপ্রয়ােজনে
জীবনে মরণে।

তাদের কর্মক্ষেত্র সুদূর প্রসারিত, দেশে-দেশান্তরে, নগরে-প্রান্তরে, এককথায় সারা বিশ্বের সমস্ত জনপদে তাদের কর্মক্ষেত্র বিছানাে। তারা শাশ্বতকালের কর্মী, ওরা চিরকাল / টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল। ওরা মাঠে মাঠে / বীজ বােনে, পাকা ধান কাটে। এভাবে তাদের কর্মযজ্ঞ চলে নিরন্তর, তাদের কর্মকলােচ্ছাসের গুঞ্জনে কিংবা গর্জনে মানবসংসার দিবারাত্রি মুখর, তাদের দৈনন্দিন কর্মের ধ্বনি ও ছন্দসুষমায় সুখ-দুঃ খময় দিবস রজনী মন্দ্রিত হয়, জীবনের মহামন্ত্রকানি হয় অভিব্যঞ্জিত। শত শত সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন আর ধ্বংসস্তূপের ওপর কমব্রতী মানুষের কর্মরথ থাকে নিরন্তর চলমান।

উৎস : রবীন্দ্রনাথের 'ওরা কাজ করে' কবিতা 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন